12 November 2013

ছারপোকার সহিত পরিত্যক্ত পশ্চিমবঙ্গে

ইংরেজি সংস্করণ

কাঠফাটা রোদে, সেকেলে গাড়ীর পাল হর্ন বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে আর অটোরিক্সার দল কানফাটা আওয়াজে রাস্তার এদিক ওদিক চলেচে। একদিক থেকে রেডিওতে ক্রিকেট খেলার কমেন্ট্রি আবার আন্যদিক থেকে আধুনিক হিন্দি গান। একদিকে হিজরার হাততালি আর একদিকে দলিত বাচ্চা মেয়ের সারিসারি গাড়ীর মাঝেমাঝে ঢুকে গিয়ে কিছু পয়সার আশায় হাতপাতা। কলকাতার এই সমপ্রতি যনযটময় জনজীবনে ১৮০০ মানসিক-বিকার গ্রস্থ কয়দিদের কি চিহ্নিত হওয়ার কোন আশা আছে? পশ্চিমবঙ্গে সরকারের বৈষম্য ও অলস রাজনীতির স্বীকার, এই মানসিক রোগীরা নিত্যই দলিত হচ্ছেন ভারতবর্ষের দানবীক মনস্বাস্থ্য আইনের বলয়ে। নভেম্বরের শুরুর দিকে আমি দুটি মানসিক শ্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাই এবং দেখি মানবাধিকারের জায়গায় রাজ করছে ছারপোকার দল! অঞ্জলি নামক এক এনজিও যদিও বা চেষ্টা চালাচ্ছে এই বন্দিদের ঘরে ফেরানোর কিন্তু সত্যই কি তাদের মুক্তি সম্ভব এই নরককুণ্ড থেকে?

বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে, যেটা প্রধানত একটি গরীব মুসলমান এলাকা, দুটি মানসিক হাসপাতালে আমি পদার্পণ করি।

"আমার বাবা আমাকে ১৬ বছর আগে এখানে নিয়ে আসে", বলল সঞ্জয়া; এক ২৯ বছরের মহিলা। তার পরিবার খুব ভয় পেয়ে যায় যখন ১৩ বছর বয়সে তার মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। তাকে কোন সাহায্য না করে, তার পাশে না দারিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় লুম্বিনি পার্ক ইন্সটিটিউশনে যেখানে সে বঞ্চিত হয় তার যৌবন থেকে, শিক্ষা থেকে, এবং সুরক্ষা থেকে। ১৬ বছর ধরে আটক – কোন অপরাধ ছারা, তাকে শুধু একবার বেরোতে দেওয়া হয়েছিল দু’বছর আগে। সে তার পরিবারে ফেরৎ যায় যেখান থেকে তাকে পরিত্যাগ করা হয়েছিল। "আমি গিয়েছিলাম এবং কেঁদেছিলাম, আমি থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার পরিবার আমাকে রাখতে চায়নি", সে আমাকে বলল।

সঞ্জয়া ৯৬ জন কয়েদিদের মধ্যে একজন লুম্বিনি পার্ক ইন্সটিউশনে যেটি কলকাতার এক গরীব মুসলমান এলাকায় – কসবা পুলিস থানার অধীনে। আমি ‘কয়েদি’ শব্দটি ব্যবহার করছি কারণ এখানে মানুষ বহু বছর ধরে আটক। নবীনা, যে একজন ৬০ বছরের মহিলা, আমাকে বলল সে একজন কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করছিল, কিন্তু তার স্বামীর মৃত্যুর পরে বিষণ্ণতায় ভোগে। তার ভাই তাকে এই প্রতিষ্ঠানে আনে – ১৩ বছর আগে। "আমি ফিরে যেতে পারবোনা, তাই আমাকে এখানকার পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিতে হবে", সে আমাকে বলল, আসন্ন জীবনের আসহায়তা বোধ করে। সে এবং আরও অনেক মহিলা যাদের সাথে আমি কথা বলেছি – অভিযোগ জানিয়েছে সেখানকার খাবার ও বিছানায় ছারপোকা সম্বন্ধে। তারা সবাই বাড়ি যেতে চায়।

আমি থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার পরিবার দেয়নি" লুম্বিনি পার্ক ইন্সটিটিউশন কলকাতায়, এটা নেপালের একটি জায়গার পর নামকরণ হয় যেখানে বুদ্ধ জন্মগ্রহন করে।

 

প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে রাখা হল বাচ্চাদের

পুরুষ বিভাগ নিচে এবং আমি পরিচালকের সাথে কথা বললাম। কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর সে আমাকে বলল যে, সব থেকে ছোট যে কয়েদি তার বয়স ১৩ বছর। আমি ভাবলাম এই বাচ্চাদের এইখান থেকে নিয়ে গিয়ে কি বাঁচানো যায়! সেটা অসম্ভব উপ্লব্ধি করার পর আমি জিজ্ঞেসা করলাম বাচ্চাদের প্রাপ্তবয়স্ক বিভাগে রাখায় কর্মীদের কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে কিনা। "না", ছিল বিভাগের পরিচালকের উত্তর। আমি হতবম্ব হয়ে গেলাম। সেই উত্তর স্পষ্ট করে দিল বেশিরভাগ সংগঠনের দায়িত্বহীন পরিবেশের কথা, যেখানে আশ্রিত বাচ্চারা অবধারিত ভাবে শারিরিক ও যৌন নির্যাতনে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ গভিরতর মানসিক ক্রোধ ও অবসাদে ডুবে যাচ্ছে। সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই তারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্ছিত হয় এবং দারিদ্রের জিবনের দিকে পা বাড়ায়। প্রশঙ্গত, এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে একবার যদি কারোর ব্যাক্তিত্তে ‘পাগল’-এর তকমা বসিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অন্য সকল গুণাবলী অবহেলা করে, শিশু, বৃদ্ধ, শ্রমিক, নারী, পুরুষদের নির্বিশেষে সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেখানে সবাই সমানভাবে অবহেলিত ও অপমানিত।

একতলায় থাকা পুরুষরা ও ১৮ বছরের কম বয়েসী কিশোররা।

 

জনজোয়ারের সাথে বন্দী

 

পশ্চিমবঙ্গে ৫টি প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোতে বসত করছে ১৮০০ মানুষ। এগুলোর মধ্যে সব থেকে বড় হল প্যাভলভ, বর্তমানে এখানে বাস করছে ৪২০ জন কয়েদি, কিন্তু সেখানে মাত্র ২৫০টি বিছানা আছে। আমরা পুরুষ বিভাগে গেলাম যেটি একটি তিনতলা ইমারৎ। তার প্রতি তলায় একটি করে বিশাল শয়নকক্ষ ছাড়া কিছুই নেই। সেখানে আমাকে ঘুড়িয়ে দেখাল দীনাথ নামক একজন পুরুষ যাকে তার মানসিক অসুস্থতার জন্য তাকে তার ধনী পরিবার থেকে পরিত্যাগ করা হয়েছিল। আমার সাথে থাকা একজন বলল তার পরিবার তাকে সেখানে ঠিক আটকে রাখবে, যার মানে হল যে তার পরিবার খুব সহজেই সঠিক লোককে টাকা দিয়ে তাদের উন্মাদ আত্মীয় কে আটকে রাখতে পারবে।

 কয়েদিদের কথা শুনছে বা শুনছি।

আমি দুপুরের খাবার খেয়ে প্যাভলভে গেলাম। প্রতিটি তলার শয়নকক্ষই হল একটি বড় ঘর যেখানে অনেক বিছানা আছে। আমি মাঝের তলায় সময় কাটালাম। সেখানে ৮৪ জন কয়েদি ৫৮ টি বিছানা ভাগ করে তালাবন্ধ ঘরে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ঘুমিয়ে ছিল কারণ তাদের ‘নিউরোলেপ্টিক’ ওষুধ নিতে বাধ্য করা হয়। আমি গরাদের বাইরে থেকে দু’জন কয়েদির সাথে কথা বললাম, তা দেখে আরও অনেক লোক দেখতে এল – কে এই কৌতূহলী বিদেশী আগন্তুক। আমি ঐ বিভাগে আধঘণ্টা থাকাকালীন একজন কর্মীও দেখতে পাই নি। আমি এই রকম প্রতিষ্ঠানে যাই নি যেখানে কর্মীরা প্রকাশ্যে আসে না – সাধারনত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত থাকে যেখানে কর্মীরা প্রতি মুহূর্তে নজর রাখে এবং আমাকে বাধা দেয় কারোর সাথে ব্যাক্তিগত ভাবে কথা বলতে।

"আমার নাম রাজা নম্বর ২", বলল একজন যে তিন বছর ধরে আটক রয়েছে। "নম্বর ২ কারণ সেখানে ইতিমধ্যেই রাজা নামক আর একজন আছে। সে আমার সাথে তালা বন্ধ গরাদের ভিতর থেকে কথা বলল। কয়িদের সকালে এক ঘণ্টা ও বিকেলে এক ঘণ্টা বেরোতে দেওয়া হয়। সেখানে পাতলা বিছানা ও মেঝের উপর শোওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এটা পরিস্কার যে শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে কারণ তা না হলে কোন মতেই ৫৮ জন পুরুষ দিনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকবে না। সকাল বেলায় ঝিমোনো, জড়ানো কথা, পিঠ দোলানো, অনৈচ্ছিক হাত নাড়ানো – সেটাই প্রমাণ করে।

 

বেআইনি গ্রেফতারি

সরকারের দায়িত্ব মানুষকে সাধারণ সাম্প্রদায়িক জীবনে ফেরত আনা, কিন্তু এটা ঘটবার কোন সুসঙ্গত উপায় নেই। বিপরীত ভাবে এই সামাজিক গঠন এক কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি করেছে রোগীদের পুনর্বাসনের; রোগীদের আত্মীয়রা তাদের ফেরত নিতে একাধিক সময় রাজি হয় না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুনর্বাসনের নীতির খসড়া অনুসারে হাসপাতাল ‘সুপারিন্টেন্ডট’ রা রোগীদের মুক্তির কোন দায়িত্ব নিতে চান না। এই নথি বলে যে ‘নিরাপত্তার ভিত্তিতে এটি সমর্থন যোগ্য’। স্পষ্টত, কোন নির্দিষ্ট মন্তব্যে পৌছনোর আগে বিষয়টি আইনগত দিক থেকে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন যতক্ষণ এই সরকার ধীরগতি তে আইনি দিক ব্যাক্ষা করে(২০১৩ সালে এই নথি প্রকাশিত হয় এবং এখনও সরকার কিছু ব্যাক্ষা করে নি)। ১৯৮৭ মানসিক স্বাস্থ্য আইনে চোখ বোলালে বোঝা যায় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান বেআইনি। সুপারিন্টেন্ডেটের কোন ক্ষমতা নেই কোন ব্যাক্তি কে আটক করে রাখা – আরও যখন সেই ব্যাক্তি আর মানসিক রোগের স্বীকার নন এবং কোন ঝুকি নেই তার স্বাভাবিক জীবন যাপন করবার। রোগীর আত্মীয়দের গ্রহণযোগ্যতা এক অতিরিক্ত আইনগত এবং অপ্রাসঙ্গিক ব্যাক্ষা যা এই সুপারিন্টেন্ডেটরা খারা করে থাকেন। এর মানে এই যে ১৮০০ মানুষ অবৈধভাবে আটক হয়ে আছে, বিদ্যমান আইন থাকা সত্ত্বেও। আরও বিষ্ময়কর এই যে বন্দীদের তরফ থেকে এখনও কোন অভিযোগ দাখিল করা হয়নি।

 

 

ক্ষীণ আশা

আমার এই প্রতিষ্ঠানগুলি ঘুরে দেখা আয়োজিত হয়েছে এক সামাজিক অধিকারের এনজিও অঞ্জলি যেটা ১২ বছর ধরে এই সংগঠনে কাজ করছে। অঞ্জলি সংস্থাগত মানুষদের বিষণ্ণ জীবনে এক আলো আনে। তারা এমন একটা সিস্টেমের সাথে লড়াই করেছে যারা মূলত গ্রাহ্য করে না। অঞ্জলি পুনর্বাসনের সংক্রান্ত কার্যক্রম চালায় এবং তাদের কাজকে আমি ধন্যবাদ জানাই। শেষ ছ’মাসে ১৪জন কয়েদিকে ৩টে প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত করেছে। এটা কোন ছোট কৃতিত্ব নয় একটা সংস্থার জন্য যেখানে ৩৫জন কর্মী আংশিক সময়ের কর্মী সহ কাজ করে। অঞ্জলির প্রধান ভূমিকা হল এইসব প্রতিষ্ঠানগুলির উপর নজর রাখা। তাদের চোখ-কান এই প্রতিষ্ঠানগুলির উপর যদি না থাকত তাহলে এইগুলি আরও খারাপ অবস্থায় থাকত, আর প্রতিপক্ষে যখন অঞ্জলি ১৩ বছর আগে কাজ শুরু করে তখন এই প্রতিষ্ঠানগুলি ভয়ঙ্কর অবস্থায় ছিল। এখনও এই জায়গাগুলিতে অনেক সমস্যা আছে যেগুলির উপর অঞ্জলি খুব দ্রুত কাজ করে। জুন ২০১৩ তে আনুমানিক ৪০জন কয়েদিকে অনশন করে অতীব জঘন্য খাবারের অভিযোগ নিয়ে। অঞ্জলিকে ধন্যবাদ তাদের গান্ধীবাদী প্রক্রিয়া স্থানীয় গনমাধ্যমে আবৃত করা হয় এবং তার ফলে খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আসে যেমন মাংস, ডিম, আলুসেদ্ধ, কাঁচালঙ্কা – যেমনটা কয়েদিরা চেয়েছিল। কয়েদিরা ওজন অর্জন করেছে এবং আগের মত অপুষ্টি-আক্রান্ত নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল তারা অনুভব করেছে তাদের কথা শোনা হয়েছে।

রাত্নাবলী রায় ব্যাক্ষা করছেন কেন প্যাভলভ বন্দীরা অনশনে বসেন।

পশ্চিমবঙ্গের মানসিক স্বাস্থ্য প্রধান – আমার ভাল বন্ধু – রত্নাবলী রায় যে অঞ্জলি ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করছে। তার অন্তরভুক্তি দৃষ্টি খুব সরল। সাম্প্রদায়িক জীবনের জন্য একটি বিশাল পরিকাঠামো প্রয়োজন হয় না, কিন্তু একটি ‘সম্বলিত-সম্পদায়’ সংগঠনের জন্য মানুষের সাথে কাজ করা প্রয়োজন। সে কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রবেশ করার জন্য। পসছিমবঙ্গ সরকারের সাথে একটা সম্পর্ক বজায় রাখা – যার অবদানে প্রতিষ্ঠানগুলিকে সচল রাখা হয় – খুব কঠিন, এই সম্পর্ক খুব সহজেই ভেঙে যেতে পারে। পদ্ধতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের জন্য যথেষ্ট বন্ধুত্তপূর্ণ, কিন্তু স্বাধীন সহযোযিতের জন্য যথেষ্ট নয়।

অঞ্জলির কার্য্যালয়ের ভিতর।

রত্নাবলী হলেন প্রথম ব্যাক্তি যিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই সঙ্কট পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করে কাটিয়েছেন। যেমন, একজন মহিলাকে - যে এক প্রতিষ্ঠানে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে অসহযোগিতায় এবং কর্মীদের দুর্ব্যবহারে – আইনি সহায়তা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন; এক প্রতিষ্ঠানকে আদালাতে তোলা যেখানে একজন কয়েদি মাথার চোটে আপাতকালীন চিকিৎসা না পেয়ে ৩ দিনে মারা যায়; প্রতিষ্ঠানগুলোর গুলোর যে নুন্যতম স্বাস্থ্যবিধি ও পরিস্কার-পরিছন্নতা আছে – সেটিকে উন্নতশীল করা। তাই এমডিএসি ও অঞ্জলি আলোচনা করছে যে কেমন করে আমরা একত্র কাজ করে একটা মোকদ্দমা কৌশল গঠন করতে পারি যেটা সরকার কে বাধ্য করবে পরিবার-পরিত্যাক্ত মানুষদের সহায়তা করবে, নিরব মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে না পড়ে।

পরিচয় সুরক্ষার জন্য সব নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

FOLLOW ME

toggle